প্রেমের কবিতা যেমন স্নিগ্ধ এবং কোমল, তেমনি এতে রয়েছে এক অদ্ভুত শক্তি যা হৃদয়ের সব কোণে পৌঁছে যায়। প্রেমের অনুভূতি কখনো স্নিগ্ধ বৃষ্টি, কখনো আবার তীব্র ঝড়ের মতো, যা কবির ভাষায় এক অসীম রূপ পায়। প্রেমের কবিতা তাই শুধু একটি ছোট মুহূর্তের কথা নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক এবং অভ্যন্তরীণ যাত্রা। এটি দুই মানুষের মধ্যে এক সম্পর্কের সেতু গড়ে তোলে, যা একসাথে সময় পার করার এক অমলিন অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
প্রেমের কবিতায় যেমন থাকে দুই প্রানের মিলন, তেমনি থাকে অপেক্ষা এবং আকাঙ্ক্ষার এক তীব্র অনুভূতি। যেমন আপনি বলেছেন, এই কবিতা শুধুমাত্র রোমান্টিক ভালোবাসার কথা বলে না, বরং এটি দুঃখ, বিষাদ, বিরহ, বা নির্জনতাও প্রকাশ করে—যা প্রেমের জটিলতা এবং তার অসীম প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি।
বিখ্যাত প্রেমের কবিতা
বিখ্যাত প্রেমের কবিতা মানবজীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং চিরকালীন অনুভূতিকে প্রকাশ করে, যা দুই হৃদয়ের এক অদৃশ্য সেতু গড়ে তোলে। বিশ্বজুড়ে অনেক কবি তাদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে প্রেমের গভীরতা, আনন্দ এবং কষ্টের নানা দিক তুলে ধরেছেন।
বিশ্বজুড়ে কবিরা প্রেমকে শুধু মানবিক সম্পর্কের দিকে সীমাবদ্ধ না রেখে এটি আধ্যাত্মিক এবং সার্বজনীন অভিব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন, যা আজও পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
সে
জীবনানন্দ দাশ
আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;
বলেছিলোঃ ‘এ নদীর জল
তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল;সব ক্লান্তি রক্তের থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।’
‘এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?’মাছরাঙাদের বললাম;
গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।
আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;
জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে
কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।সময়ের অবিরল শাদা আর কালো
বনানীর বুক থেকে এসেমাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে
ঢের আগে নারী এক – তবু চোখ ঝলসানো আলো
ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি
না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।অনন্ত প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরতোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার,
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার-কত রূপ ধ’রে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী,প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতিপুরাতন বিরহমিলন-কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষেকালের তিমির রজনী ভেদিয়া
তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রবতারকার বেশে।আমরা দু’জনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয় উৎস হতে।আমরা দু’জনে করিয়া খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝেবিরহবিধূর নয়নসলিলে
মিলনমধুর লাজে।
পুরাতন প্রেম নিত্যনতুন সাজে।আজি সেই চিরদিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিলপ্রাণের প্রীতি
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে-
সকল প্রেমের স্মৃতি,
সকল কালের সকল কবির গীতি।ভুলো না
রাম বসু
তোমার পাশে দাড়িয়ে ভাঙ্গা পৃথিবী সাজাবো
স্বপ্ন ছিল, সাগরে ধোবো মনের আঙিনা
তারার ঘুম ঘুচিয়ে সেতার শোনাবো
ধানের বানে আকাশ ভাঙা বিরাট চেতনা
হৃদয় ধরে খোকার চোখে চুমায় হারাবো।
স্বপ্ন ছিল সাগরে ধোবো মনের আঙিনা
হায় রে মন ত্রাসের ভাঙা উজাড় আকালে
হিজল ডিঙ্গা কোথায় গোলো? কোথাও দেখি না
ঘূণিঘোর শঙখচুঢ় পাড়ের কপালে
ছোবল মারে, বলরে মন কোথায় আঙিনা?আজ ভালো থাকো
সুরজিৎ ঘোষ
তোমার সঙ্গে এত বেশি মেলামেশা
উচিত হয়নি, আর আমি আসব না।
শুধু, আজ তুমি সারাদিন ভালো থেকো
যেন তোমার ঐ সন্ধ্যাবেলার জ্বর
আজকে না আসে, তোমার গলার স্বর
একেবারে নিভে যাওয়ার কদিন আগে
আমাকে ডাকলে, যে ভাবেই হোক সেদিন আসব আবার
আজ ভাল থাকো, তোমার জন্মদিনে
এর বেশি আর কি আছে আমার চাওয়ার।ভালোবাসার আয়ু
মহাদেব সাহা
ভালোবাসি বলার আগেই
ফুরিয়ে যায় আমাদের ভালোবাসার সময়,
প্রেমের আগেই শুরু হয়
অন্তর বিরহ-
মনে হয় সবচেয়ে কম মানুষের এই ভালোবাসার সময়
খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায় তার আয়ু;
মানুষ মিলন চায়, কিন্তু তার বিচ্ছেদই নিয়তি।
কোনো একদিন সময় করে যে
বলবে ভালোবাসি
বলবে যে ভালোবাসা চাই,
এতোটা সময় কই
ভালোবাসা বলার আগেই দেখবে ফুরিয়ে যায়
ভালোবাসার সময়,
শেষ হয়ে যায় তার আয়ু।ভালোবাসা ও দু:খ
হাবীবুল্লাহ সিরাজী
ভালোবাসার কোন ঠিকানা ছিল না,
ভালো কি মন্দ দু:খের কোন নাম নেই।
একদিন দু:খ ভালোবাসাকে খুঁজতে বেরুলো
অরণ্য ও জনপদ শেষ করে সমুদ্রের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো:
‘ভালোবাসার খোঁজ রাখো?’
‘এই তো তোমার আসার আগেই বাতাসের সঙ্গে দক্ষিণে গেলো;
দু:খো আকাশের দিকে চাইল
নীল হতে হতে আগুন মুখে আকাশ বললো:
‘ভালোবাসা! তার তো কোন ঠিকানা থাকতে নেই।
দু:খকে কি নামে ডাকা যায়
ভাবতে ভাবতে ভালোবাসা যখন দু:খের ঘরে ঢুকলো
দু:খ তখন বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল আড্ডায় মত্ত-
কোন কিছু বলার আগেই
ভালোবাসার গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো
আর ভালোবাসার মন ডাক দিলো-‘দু:খ’।
সেই থেকে ভালোবাসা এবং দু:খ
এক বাড়িতে উপরে-নীচে বসবাস করে।
সারারাত দু:খের ঘুম হয় না-আর
ভালোবাসা স্বপ্ন দেখে; নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে খসে পড়ছে স্মৃতি,
পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে যাচেছ সোনালী মৌমাছি।
সমুদ্রের গুল্মপাতা আর মাছে কোন প্রভেদ নেই-
ভালোবাসা নিচে নামে।
উনুনে জল ফুটছে
দু:খ তখন ভালোবাসার শয্যায় নিদ্রামগ্ন
ভালোবাসা অপেক্ষায় থাকে
দু:খ প্রতিক্ষা,
ভালোবাসা হেমন্তে বুক খুলে দিলে
দু:খ উল্টে দেয় শীতের কুয়াশা,
দু:খ এবং ভালোবাসা ঘৃণা ও অহংকারে
যৌবন স্পর্শ করে জীবনের কাছে যায়
সেখানেই তাদের ঠিকানা ও নাম।
আরো পড়ুন: পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ
রোমান্টিক প্রেমের কবিতা
রোমান্টিক প্রেমের কবিতা এমন একটি সাহিত্যকর্ম, যা প্রেমের গভীরতা, সৌন্দর্য, কোমলতা এবং আবেগের সূক্ষ্মতা তুলে ধরে। এই কবিতাগুলির মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কের স্নেহময়তা এবং একে অপরের প্রতি এক অদৃশ্য আকর্ষণ প্রকাশিত হয়।
রোমান্টিক প্রেমের কবিতাগুলো সবসময়ই হৃদয়ের গভীর অনুভূতি থেকে সৃষ্টি হয় এবং এর মাধ্যমে প্রেমিকার প্রতি এক অগাধ ভালোবাসা প্রকাশ পায়। এখানে প্রেমের এমন এক অনুভূতি উঠে আসে, যা অন্য কারো দ্বারা অনুভূত করা সম্ভব নয়।
রোমান্টিক প্রেমের কবিতায় এমন এক জগতের সৃষ্টি হয়, যেখানে প্রেমিকার চোখে ভালোবাসা, তার হাসিতে মাধুর্য, তার উপস্থিতিতে শান্তি এবং এক ধরনের অদ্ভুত মায়া থাকে।
শুধু তোমার জন্যে
চুলে লেগেছিল কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটা
সেদিন তোমার নাম রেখেছি গোলাপ
হারা ভারতবর্ষ হলো শান্তির নীড়
ঘর হয়ে উঠল অরণ্য বিভুই।
রোদের কানে কানে ফিসফিসিয়ে কথা
দূরত্ব তোমার আমার মাঝখানে হাজারো-
পলকহীন মাছের চোখের মতো..
স্বচ্ছ জল তুমি আর আমি স্পষ্ট সেদিকে তাকিয়ে।
শুধু তুমি
ওই আকাশটা নীলচে দেখো
ওই সাগরের সাথে কত মিল।
তোমার কেন? জানো ভালোবাসার জন্য।
অল্প অল্প মেঘ, হালকা হালকা বৃষ্টি হয়
ছোট্ট ছোট্ট গল্প থেকে, হাজারো ভালোবাসা সৃষ্টি হয়।
মাঝে মাঝে ক্ষমা করলে, সম্পর্কটাও মিষ্টি হয়।
এক ফোটা জল যদি কখনো আমার চোখ দিয়ে পড়ে,
সেই জলের ফোঁটা শুধু তোমার কথাই বলে।
মনের কথা কেন বোঝনা তুমি?
বন্ধু তোমায়
বন্ধু তোমায় ঠিক কি নামে ডাকি বলতো,
যে নামে ডাকলে তোমাতে আমি থাকবো,
যে নামে ডাকলে তোমার মুখে হাসি থাকবে সারাক্ষণ,
আমি তোমায় সেই নামেই ডাকবো, যে নামে সবাই তোমায় চিনবে।
বন্ধু তুমি একা হলে আমায় ডাক দিও,
সব ফেলে আসবো ছুটে, যতই থাকুক কাজ
যদি তুমি কষ্ট পাও, আমায় ভাগ দিও
শেয়ার করো আমার সাথে, হাতটি রেখো হাতে।
মেঘের হাতে একটি চিঠি
পাঠিয়ে দিও আমার জন্য,
অনেক দূরে যদি থাকি
তাও থাকবো তোমার সাথী হয়ে।
আরো পড়ুন: মিয়া খলিফার জীবনের ইতিহাস, খবর এবং ফেসবুক আইডি
আবেগি প্রেমের কবিতা
আবেগি প্রেমের কবিতা হলো এমন এক ধরনের কবিতা, যেখানে প্রেমের অনুভূতি অত্যন্ত গভীর আবেগের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। এসব কবিতায় থাকে প্রেমিকার প্রতি অপ্রকাশিত আকাঙ্ক্ষা, হৃদয়ের অন্তর্গত স্পন্দন, এক ধরনের ব্যাকুলতা এবং ভালোবাসার তীব্র অনুভূতি।
আবেগি প্রেমের কবিতা প্রেমের গভীরতা, আকাঙ্ক্ষা, প্রার্থনা, ব্যাকুলতা এবং ভালোবাসার তীব্রতা তুলে ধরে। এগুলি এমন কবিতা, যা হৃদয়ের অবস্থা এবং অনুভূতির বাস্তবতা সামনে আনে।
প্রেমিক
সে একদিন গাছ হয়েছিল..
শহরের অশ্রুত শব্দের মত
মস্ত মস্ত কুঠোর এসে তার হাত পা শিকল ভেঙে দিল-
তাই তার সমস্ত নীড় ভেঙে গেল।
সে একদিন পাখি হয়েছিল..
উড়তে উড়তে সে দেখেছিল
তার প্রেমাস্পন্দনের চোখে অন্য কারো ঠোট, ঠোঁটে অন্য কারো গাল-
তারপর তার সব পালক ঝরে পড়ে গেল।
সে একদিন বাঘ হয়েছিল,
মস্ত বড় এক হিংস্র বাঘ।
বহু সন্তর্পণে নজর রাখার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পরেই..
সে তার চোখে দেখেছিল আতঙ্ক
রোদের কানে কানে ফিসফিসিয়ে কথা
দূরত্ব তোমার আমার মাঝখানে হাজারো
আর নয়ন ভরা অশ্রু।
তাই তার সমস্ত থাবার নখ এখন খসে গেছে।
প্রিয়জনের জন্য তার হৃদয় হয়েছে এখন ক্ষতবিক্ষত
যে হৃদয়ে রয়েছে এখন কান্না ভরা হিংস্রতা।
নিষ্পাপ ভালবাসা
পাহাড় থেকে নেমে এসে দাঁড়ালে, পর্বতের পাশে
মেঘ লেগে সারা গায়ে, ঠোঁটে।
হিমালয়ের নীল আকাশ মনের সাথে কথা বলে।
এসব সবই আমাদের মনের খেলা,
ঠিক যেমনই ভালোবাসার মানুষ নিত্যদিন প্রতিটি মানুষের সাথে খেলা করে!
যার স্বাভাবিক শুনলেও, আমাদের মন কাঁদিয়ে দেয়।।
তোমার অগোছালো দৃষ্টি,
আমায় নয় স্বর্গিক। ভালবাসার দিকে নিয়ে যায়।
ভোর হয়েছে স্বর্গ বিদীর্ণ করে দেয় সুদীর্ঘ সকাল।।
সাদা পারিজাত হতো না মনে হয়।
তোমাকে দেখার পর মনে হল এরপর থেকে ফুটবে।
মনে হওয়াও নয়| নয় অবভাস।
নিশ্চিত প্রত্যয় জানি
ফুটে থাকবে পর্বতে পর্বতে।
মানুষের থেকে দূরে,কচ্চিত দেখা মিলবে অনেক আরোহনে।
এসব না শুনেও তুমি হাসছো, স্কাফটা দুলছে। আমার হলো না ফেরা । আপাতত এক বুক ভরা সাহস নিয়ে সাঁতার কাটছে রাজহাঁস।
অপেক্ষা একটা ভোরের
কাঠবিড়ালির ঠোঁটে ভর করে প্রতিদিন র্সুয ওঠে
চাতকের ছোট্ট ডানায় পাখা মেলে সজল বরষা আসে,
ভিজিয়ে দিয়ে যায় হৃদয়ের সব অলিন্দ।
চির নতুন, চির তরুন হয়ে বেঁচে থাকে
”সুন্দর” যা কিছু চিরন্তন।
অনিমেষ অপেক্ষায় থাকি।
স্মৃতির পাতায় খুঁজে নেওয়া প্রিয় মুখ, চেনা কণ্ঠস্বর
প্রিয় কিছু শব্দ যা চিরন্তন নতুন।
শুধু অপেক্ষা একটা ভোরের
ঘাসের বুকে জমে থাকা ছোট্ট অমলিন শিশির বিন্দু
যেন এক একটা সাত রঙা নিষ্পাপ পৃথিবী,
দরজায় কড়া নেড়ে জানান আমাকে ,
এই তো তোমার পৃথিবী, সব দিলাম।
এবার দুঃখ কষ্ট সব ভুলে যাও তুমি প্রিয়…………..
হারানো ভালোবাসা
কিছু কিছু কথা যা চিরদিন নীরবে রয়ে যায়
কিছু কিছু ব্যথা যা কখনো হার মানিতে না চায়
কিছু কিছু স্মৃতি যা সদাই ভুলে যেতে চাই
কিছু কিছু কথা যা কুম্ভ মনে নাহি পরাজয়|
তাও চলেছি পথেই জীবনে জানি নেই আলো
বলিতে পারিনা মুখে তবু যাই থাক ভালো
জীবনের স্রোতে যে মায়া ছাড়িলে সাথে
তারই মাঝে মিশে আছি আমি
যদি অন্তর দিয়ে কভু দেখো
যে প্রদীপ নিভে গেছে আঁধারে
আগুনে না ভালোবাসা দিয়ে তা জ্বালো।
তীব্র প্রেমের কবিতা
তীব্র প্রেমের কবিতা বলতে বোঝায় এমন কবিতা, যেখানে প্রেমের অনুভূতি অত্যন্ত শক্তিশালী, গভীর এবং আবেগপূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়। এই কবিতাগুলির মধ্যে প্রেমের প্রতি এক অবর্ণনীয় আকর্ষণ, হৃদয়ের স্পন্দন, এবং ভালোবাসার অগাধ তীব্রতা ফুটে ওঠে।
তীব্র ভালোবাসা
চেয়ে আছি আমি দূর আকাশে, রাতের তারা দেখি
তুমি ছাড়া এ জীবনটা আমার শুধুই দিশেহারা।
আমাকে তুমি যতই দূরে রাখো তবুও কাছে আসবো,
কষ্ট তুমি যতই দেবে, আমায় তোমাতেই ভালোবাসবো।
চেয়ে দেখো দূর আকাশে চলছে অনেক তারা
প্রথম দেখায় তোমাকে আমার লেগেছে অনেক ভালো
তোমায় নিয়ে আমি চলে যাব ওই বহুদূরে
শুধু আমায় জায়গা দিয়েও তোমার মনের মনিকোঠায়।
স্বপ্ন আমি তোমায় নিয়ে বুকের মাঝে রাখি,
দিবানিশি তোমার ছবি আমার মনেই আঁকি।
চাঁদ হয়ে তুমি জ্বলে থাকবে, আমার মনের ঘরে
ভালোবাসা দিয়ে তোমায় রাখবো যতন করে।
হাতে হাত রেখে বলো,কোনদিন ছেড়ে যাবে নাকো
তোমায় ছাড়া এই জীবনে আমার কিছু আর নাইকো।
কাজে আমার মন বসে না, তোমার কথাই ভাবি
তুমি আমার জীবন মরণ তুমি আমার সাথী।
এই মনেতে তুমিই থাকো,আর থাকে না কেউ
আর শুধু তোমার জন্য বুকের মাঝে অকুল ঢেউ।
আজ আমায় তুমি কথা দাও ,যাবে না তো দূরে….
তুমি দূরে গেলে আমি হারাবো চিরদিনের তরে।
প্রেম আগুনে জ্বলে পুড়ে আমি যাচ্ছি মরে
কখন তুমি যতন করে, রাখবে আমায় মনের ঘরে।
আর কতকাল থাকবো একা? গুনবো কতদিন
ভালো থাকতে পারিনা আমি, কাটছে না আমার দিন
কখন দিবে তুমি সাড়া, আসবে আমার কাছে।
আলতো উষ্ণ ছোঁয়া
আমার দেওয়া ফুলে ধুলো যদি লাগে ভুলে
আমার কথা কুসুম ম্লান হবে না কোন কালে…
জীবনের যত অভিমান ভুলায় তুমি,
ছুঁয়ে দিও আমারে তোমার কোমল হাতের ডালে।
তোমার রূপে আমি আপন হয়ে ঘুরেছি বিশ্ব মাঝে।
আজ তোমার রূপে সেজেছি আমি যাইব তোমার লোকে।
ভেদের প্রাচীর মিটায়েছি আজ..
অখিল বিশ্বে দেখি আপনারই রূপ
যেথা আমি সেথায় তুমি,
এক হয়েছি আজ দুজন।
গভীর প্রেমের কবিতা
গভীর প্রেমে থাকে এক প্রকারের অদৃশ্য ও অমলিন সংযোগ, যা প্রেমিক এবং প্রেমিকার মধ্যে শুধুমাত্র শারীরিক বা বাহ্যিক সম্পর্ক নয়, বরং মানসিক, আত্মিক এবং কখনো কখনো আধ্যাত্মিক স্তরে গড়ে ওঠে।গভীর প্রেম এমন এক অনুভূতি যা অনুভূতির সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে, এবং যা শুধুমাত্র দেহের নয়, মন এবং আত্মার সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ।
এটি কোনও শারীরিক আকর্ষণ বা প্রলোভনের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং এক অগাধ আন্তরিকতা, বিশ্বাস এবং একে অপরকে জানার অভ্যন্তরীণ তাগিদ থেকে জন্ম নেয়।
প্রেমহীন ভালবাসা
প্রেমহীন ভালবাসা সুখের আশ্বাসে
দীর্ঘ সংগমে রাত্রি জাগরণ শেষে
ক্লান্ত চোখ খুঁজে বেড়ায় আবারও সুখের প্রদীপ
হৃদয়ে প্রেম নেই শুধুই আছে ভালবাসা,
ক্ষণিকের জ্বালা-দ্বীপও।
প্রেম হীন দীর্ঘ রজনি চাই না আমি,
চাই না চোখ ধাঁধানো আলোর ঝিলিক-রশ্নি
স্বচ্ছ স্রোতস্বিনী জলের ন্যায় অবগাহনের জল চাই,
হোক নিভু নিভু ছোট্ট প্রেমের প্রদীপ
হোক না কয়েক পলক, হোক কিছু সময়
তবুও প্রেম থাকুক আমাদের মাঝে বেঁচে
গা-ছুঁয়ে যাওয়া ছোট্ট প্রহর,
দিবা-নিশি জেগে রই তোমারি মাঝে।।
ভালোবাসার স্মৃতি
তোমার চোখে চোখ মিলিয়ে
নির্ভেজাল স্বপ্ন আঁকি
দুঃস্বপ্নে না উঁকি দিলে আজ
খেয়াল তাদের দিকে রেখো|
আপনেরা হয় স্বার্থপর
ঘুমও কেড়ে নেয়
আপন পর দুচোখে হাজারো স্মৃতি
স্বপ্নেরা তাই আজ বিস্তৃতি।
জীবনানন্দ দাশ
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।
স্বীকার উক্তি
মুসলেহ উদ্দীন
কতখানি ভালবাসি প্রশ্ন করেছিলে
সন্দিহান চোখে দুটি দ্বিধাহীন মেলে
ভালোবেসে যদি হয় মৃত্যু পরিণাম
জেনে রেখো তবু আমি ভালোবেসেছিলাম।
পৃথিবীর সেরা প্রেমের কবিতা
(১)
এ যেন এক অনন্য অনুভূতি
স্পর্শ করে যায় মনের গহরে
চোখ যায় দিগন্ত থেকে দিগন্তে-
ততই মন হয় হন্তদন্ত।
ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়
মাঠের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে-
গাছের দোদুল দুলুনি
দেখে মন হয় দিশেহারা।
প্রেম মলিন হয়
পৃথিবীর সেরা প্রেমের কবিতা হয়ে।
রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়,
গাছের দুলানি তবুও থামেনা-
হাওয়াতে দোদুল দুলতে থাকে
জোসনার এক ফালি চাঁদের কিরণে।
মায়ার বন্ধন
জীবনে যদি মরে কাছে ডাকিতে নাহি পারো
মরনে আমারে তুমি তোমার করিয়া নিও
যতদিন আছি আমি তোমারি হয়ে আছি
বোঝো না তাও, তুমি আমার কত প্রিয়।
হৃদয়ে দিয়েছিস স্থান তোমারি চিরতরে
দিলে না তুমি ওগো তারে যে কোন মান
অসহায় হয়ে আমি আছি, তব মুখ চেয়ে
পারো যদি ভালবেসে দিও ওগো তার দাম|
হঠাৎ যদি আমি হারিয়ে যাই চিরতরে,
ভাঙ্গে যদি ভুল তব বেদনার সুর ধরে-
ডাকিও আমারে তুমি তব মুখে নাম লয়ে-
সার্থক হবে নাম তোমার মুখে প্রিয়।
অশ্রু আসে যদি তোমার আঁখিতে ওগো কখনো,
ঝরিও আচ্ছাঅঝোরে তুমি আমার স্মৃতি লাগে-
থাকিবো না হয়তো আমি সেদিন তোমার কাছে
বোঝো না তাও ,তুমি আমার কত প্রিয়।
স্বপ্নভঙ্গ
স্বপ্ন যত চোখের পাতায়
হৃদয় বাজে প্রেমের সুর
দীর্ঘ রাত্রি তোমার ছোঁয়ায়
মলিন সুধার অমৃতের রূপ|
ঝরাপাতা আর হাতটা তোমার
কাজল চোখে লাগে অপরূপ
স্বপ্ন ভাঙার শেষে দেখি
তুমি কাছে নাই আর আমি চুপ|
হৃদয়ের ভালোবাসা
অন্তরে আলো জ্বেলে রেখো-দৃষ্টিকে গেছ শুধু আঁধারে তে ঢেকে
নিজেকে প্রশ্ন করে দেখনা, যার নাম তুমি আর লেখ না।
কেন তাকে ধরে আছো হৃদয়ে বিদায়ের পথ কেন ছাড়োনি?
কি তার জবাব দেবে যদি বলি আমি কি হেরেছি?
তুমিও কি একটুও হারোনি-
তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ আমি দিতে পারিনি|
যে পথে আর কোনদিনও ফেরা হবেনা
সেই পথ ধরে আর হাঁটতে যেও না।
সেখানে পাবে শুধু হৃদয় বিদির্ণ করা ক্ষত
রয়ে যাবে এই ব্যথা চিরত|
নজরুলের প্রেমের কবিতা
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রখ্যাত কবি, যিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে প্রেম, বিপ্লব, মানবতার এবং বিদ্রোহের কথা বলেছেন।তাঁর প্রেমের কবিতা কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল, আবার কখনো বিপ্লবী কিন্তু সব সময়ই অত্যন্ত গভীর এবং হৃদয়গ্রাহী।
নজরুলের প্রেমের কবিতা প্রগাঢ় আবেগ, বিপ্লবী মনোভাব, সমাজের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি এবং মানবিক মূল্যবোধের মিশ্রণ। তিনি প্রেমের চিরন্তন শক্তি, যা পৃথিবীকে নতুন করে দেখতে শেখায়, তার কবিতায় তুলে ধরেছেন।
অনামিকা
কাজী নজরুল ইসলাম
কোন নামে ডাকব তোমায়
নাম-না-জানা- অনামিকা
জলে স্থলে গগনে-তলে
তোমার মধুর না যে লিখা।
গীষ্মে কনক-চাঁপার ফুলে
তোমার নামের আভাস দুলে
ছড়িয়ে আছে বকুল মূলে
তোমার নাম হে নিকা।
বর্ষা বলে অশ্রুজলের মানিনী সে বিরহিনী।
আকাশ বলে, তরিতে লতা, ধরিত্রী কয় চাতকিনী।
আষাঢ় মেঘে রাখলো ঢাকি
নাম যে তোমার কাজল আঁখি
শ্রাবণ বলে, যুঁই বেলা কি?
কেকা বলে মালবিকা।
শারদ-প্রাতে কমল বনে তোমার নামে মধু পিয়ে
বানীদেবীর বীণার সুরে ভ্রমর বেড়ায় গুনগুনিয়ে!
তোমার নামের মিল মিলিয়ে
ঝিল ওঠে গো ঝিলমিলিয়ে
আশ্বিণ কয়, তার যে বিয়ে
গায়ে হলুদ শেফালিকা।
অনেক ছিল বলার
কাজি নজরুল ইসলাম
অনেক ছিল বলার, যদি সেদিন ভালোবাসতে।
পথ ছিল গো চলার, যদি দু’দিন আগে আসতে।
আজকে মহাসাগর-স্রোতে
চলেছি দূর পারের পথে
ঝরা পাতা হারায় যথা সেই আঁধারে ভাসতে।
গহন রাতি ডাকে আমায় এলে তুমি আজকে।
কাঁদিয়ে গেলে হায় গো আমার বিদায় বেলার সাঁঝকে।
আসতে যদি হে অতিথি
ছিল যখন শুকা তিথি
ফুটত চাঁপা, সেদিন যদি চৈতালী চাঁদ হাসতে।
বেশ্যা
কবি নজরুল ইসলাম
সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে
পাপের হয়েছে শেষ,
বেশ্যার লাশ হবে না দাফন
এইটা সাধুর দেশ।
জীবিত বেশ্যা ভোগে তো আচ্ছা, মরিলেই যত দোস?
দাফন কাফন হবে না এখন
সবে করে ফোস ফোস।
বেশ্যা তো ছিল খাস মাল, তোদের রাতের রানী,
দিনের বেলায় ভুরু কোচ কাও?
মরিলে দেওনা পানি!
সাধু সুনামের ভেক ধরিয়া দেখালি দারুন খেলা,
মুখোশ তোদের খুলবে অচিরে
আসবে তোদের বেলা।
রাতের আধারে বেশ্যার ঘর স্বর্গ তোদের কাছে,
দিনের আলোতে চিননা তাহারে?
তাকাও নাকো লাজে!
চিনি চিনি ভাই সব সাধু রেই হরেক রকম সাজ,
সুযোগ পেলেই দরবেশী ছেরে দেখাও উদ্দাম নাচ!
নারী আমাদের মায়ের জাতি বেশ্যা বানালো কে?
ভদ্র সমাজে সতীর ছেলেরা খদ্দের সেজেছে?
গরীবের বৌ সস্তা জিনিস সবাই ডাকো ভাবি,
সুযোগ পেলেই প্রস্তাব দাও আদিম পাপের দাবি।
স্বামী যখন মরলো ভাবির দুধের শিশু কোলে,
ভদ্র দেবর সুযোগ খোঁজে সহানুভূতির ছলে,
দিনের মত দিন চলে যায়,
হয় না তাতে দোষ
মরা লাশের সুযোগ পেয়ে মোল্লার রোষ।
মোল্লা সাহেব নায়েবে রাসুল ফতোয়া ঝারিশা কয়,
পতিতা নারীর জানাজা কবর এই এলাকায় নয়।
শুধাই আমি ওরে মোল্লা জানাযায় যত দোষ,
বেশ্যার দান নিয়াছো ঝোলিয়ে তুমি বেটা নির্দোষ?
বেশ্যার তবু আছে পাপ বোধ নিজেকে সে ভাবে দোষী,
তোমরা তো বেটা দিন বেচে খাও হচ্ছেয় খোদার খাসি।
আল্লাহর ঘর মসজিদে ও আছে বেশ্যার দান -কলেমা পড়েছে সে ওতো তবে নামেতে মোসলমান!
বেশ্যা নারী ব্যবসায় নারী পুরুষরা পুরুষরা সব সৎ?
জানি মোল্লা খুলবে না মুখ চাকরি যাওয়ার পথ!
আর কতকাল থাকবি অমন মুখোশ ধারীর দল,
আসবো এবার মশাল নিয়ে ভাঙতে তোদের কল।
সত্যর আলো জলবে যখন চিনবে তোদের সবে,
লেবাশধারী মুখোশধারী মুখোশ উপরে যাবে।
এই ভাবে আর চালাবি কত ছল চাতুরীর খেলা।
আসবে তিনি, এবার তোদের বিদায় নেবার পালা।।।
আরো পড়ুন: ইসলামিক নামের গুরুত্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে পরিচিত, যিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে প্রেম, আত্মত্যাগ, আধ্যাত্মিকতা, এবং মানবতার চিরন্তন অনুভূতিগুলি প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতাগুলো কখনো একেবারে শুদ্ধ, কখনো মধুর অপেক্ষা, আবার কখনো দুঃখময়। তাঁর প্রেমের কবিতা শুধু রোমান্টিক ভালোবাসা নয়, বরং আত্মিক মিলনের এক অমলিন অনুভূতি।
প্রেমের হাতে ঘরা দেব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমের হাতে ধরা দেব
তাই রয়েছি বসে;
অনেক দেরি হয়ে গেল,
দোষী অনেক দোষে।
বিধিবিধান-বাঁধনডোরে
ধরতে আসে, যাই সে সরে,
তার লাগি যা শাস্তি নেবার
নেব মনের তোষে।
প্রেমের হাতে ধরা দেব
তাই রয়েছি বসে।
লোকে আমায় নিন্দা করে,
নিন্দা সে নয় মিছে,
সকল নিন্দা মাথায় ধরে
রব সবার নীচে।
শেষ হয়ে যে গেল বেলা,
ভাঙল বেচা-কেনার মেলা,
ডাকতে যারা এসেছিল
ফিরল তারা রোষে।
প্রেমের হাতে ধরা দেব
তাই রয়েছি বসে।
আমার এ প্রেম নয়তো ভীরু
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু,
নয় তো হীনবল –
শুধু কি এ ব্যাকুল হয়ে
ফেলবে অশ্রুজল।
মন্দমধুর সুখে শোভায়
প্রেম কে কেন ঘুমে ডোবায়।
তোমার সাথে জাগতে সে চায়
আনন্দে পাগল।
নাচ’ যখন ভীষণ সাজে
তীব্র তালের আঘাত বাজে,
পালায় ত্রাসে পালায় লাজে
সন্দেহ বিহবল।
সেই প্রচন্ড মনোহরে
প্রেম যেন মোর বরণ করে,
ক্ষুদ্র আশার স্বর্গ তাহার
দিক সে রসাতল।
হঠাৎ দেখা
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন।।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লাল রঙের শাড়িতে-
দালিম-ফুলের মত রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলন-চাঁপার মত চিকন-গৌর মুখখানি ঘিরে।
মনে হল, কাল রঙের একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা:
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে:
আলাপ করলেম শুরু-
কেমন আছো, কেমন চলছে সংসার
ইত্যাদি।
সে রইল জানালার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,
কোনটা বা দিলেই না।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায়-
কেন এ-সব কথা,
এর চেয়ে অনেক ভাল চুপ ক’রে থাকা।।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।
মনে হল কম সাহস নয়-
বসলুম ওর এক বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
‘কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার!
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
তাই, যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?’
আমি বললাম,বলব।
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
‘আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে-
কিছুই কি নেই বাকি?’
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তার পর বললেম,
‘রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।’
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম নাকি।
ও বললে, ‘থাক এখন যাও ও দিকে।’
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে।
আমি চললেম একা।
আচল স্মৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে
জাগিয়া রয়েছে নিতি
অচল ধবল শৈল-সমান
একটি অচল স্মৃতি।
প্রতিদিন ঘিরি ঘিরি
সে নীরব হিমগিরি
আমার দিবস আমার রজনী
আসিছে যেতেছে ফিরি।
যেখানে চরণ রেখেছে সে মোর
মর্ম গভীরতম—
উন্নত শির রয়েছে তুলিয়া
সকল উচ্চে মম।
মোর কল্পনা শত
রঙিন মেঘের মতো
তাহারে ঘেরিয়া হাসিছে কাঁদিছে,
সোহাগে হতেছে নত।
আমার শ্যামল তরুলতাগুলি
ফুলপল্লবভারে
সরস কোমল বাহুবেষ্টনে
বাঁধিতে চাহিছে তারে।
শিখর গগনলীন
দুর্গম জনহীন,
বাসনাবিহগ একেলা সেথায়
ধাইছে রাত্রিদিন।
চারি দিকে তার কত আসা-যাওয়া,
কত গীত , কত কথা —
মাঝখানে শুধু ধ্যানের মতন
নিশ্চল নীরবতা।
দূরে গেলে তবু, একা
সে শিখর যায় দেখা —
চিত্তগগনে আঁকা থাকে তার
নিত্যনীহাররেখা।
অভিমান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কারে দিব দোষ বন্ধু, কারে দিব দোষ!
বৃথা কর আস্ফালন, বৃথা কর রোষ।
যারা শুধু মরে কিন্তু নাহি দেয় প্রাণ,
কেহ কভু তাহাদের করে নি সম্মান।
যতই কাগজে কাঁদি, যত দিই গালি,
কালামুখে পড়ে তত কলঙ্কের কালি।
যে তোমারে অপমান করে অহর্নিশ
তারি কাছে তারি ‘পরে তোমার নালিশ!
নিজের বিচার যদি নাই নিজহাতে,
পদাঘাত খেয়ে যদি না পার ফিরাতে–
তবে ঘরে নতশিরে চুপ করে থাক্,
সাপ্তাহিকে দিগ্বিদিকে বাজাস নে ঢাক।
একদিকে অসি আর অবজ্ঞা অটল,
অন্য দিকে মসী আর শুধু অশ্রুজল।
আকাশের চাঁদ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাতে তুলে দাও আকাশের চাঁদ —
এই হল তার বুলি।
দিবস রজনী যেতেছে বহিয়া,
কাঁদে সে দু হাত তুলি।
হাসিছে আকাশ, বহিছে বাতাস,
পাখিরা গাহিছে সুখে।
সকালে রাখাল চলিয়াছে মাঠে,
বিকালে ঘরের মুখে।
বালক বালিকা ভাই বোনে মিলে
খেলিছে আঙিনা-কোণে,
কোলের শিশুরে হেরিয়া জননী
হাসিছে আপন মনে।
কেহ হাটে যায় কেহ বাটে যায়
চলেছে যে যার কাজে —
কত জনরব কত কলরব
উঠিছে আকাশমাঝে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতাগুলোতে একদিকে যেমন রয়েছে মানবিক সম্পর্কের সৌন্দর্য, তেমনি রয়েছে আধ্যাত্মিক এবং শাশ্বত প্রেমের ধারণা। তাঁর প্রেমের কবিতাগুলি মানবতার, ভালোবাসার, এবং আত্মীক ঐক্যের এক অনন্য উপস্থাপনা।