নামাজ হচ্ছে ফরজে কেফায়া। এই নামাজ এক দুইজনে আদায় করলেও সকলের আদায় হয়, কিন্তু কেহ আদায় না করলে সকলেই গুনাহের ভাগিদার হয়। জানাজার নামাজ ইসলামের একটি অপরিহার্য ধর্মীয় আমল। এই নামাজটি মূলত মৃত ব্যক্তির মৃতের জন্য হেদায়াত, মাগফিরাত ও আল্লাহর দয়ার আবেদন জানাতে আদায় করা হয়।
জানাযা নামাজ পড়ার নিয়ম: জানাজার নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ নামাজ, যা একজন মুসলিমের মৃত্যুর পর তার জন্য দোয়া ও মাগফিরাত কামনা করে আদায় করা হয়। নিচে জানাজার নামাজের নিয়ম বর্ণনা করা হলো:
মৃত ব্যক্তিকে একটি খাটিয়ায় রাখার সময় তাকে উত্তর-দক্ষিণ দিকের দিকে মুখ করে রাখাটা জরুরি।
ইমাম মৃত ব্যক্তির বুকের সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকবেন, এবং মুক্তাদিরা তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে জানাজার নামাজ আদায় করবেন।
জানাজার নামাজের নিয়ত
জানাজার নামাজের নিয়ত শুধু মন থেকে করতে হয়, মুখে উচ্চারণের বাধ্যবাদকতা নেই। নিচে জানাজার নামাজের নিয়ত আরবি, বাংলা উচ্চারণ এবং অর্থসহ দেওয়া হলো।

বাংলা অর্থ: আমি আল্লাহর জন্য চার তাকবিরসহ জানাজার নামাজ ফরজে কেফায়া আদায় করার নিয়ত করছি। আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও নবীজীর প্রতি দরূদ এবং এই মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করছি, এই ইমামের পেছনে, কাবার দিকে মুখ করে। আল্লাহু আকবার।”
আরো পড়ুন: তাশাহুদ দুরুদ শরীফ দোয়া মাসুরা
প্রথম তাকবির: ইমাম “আল্লাহু আকবার” বলে তাকবির দেবেন, এবং মুক্তাদিরাও একই সঙ্গে তাকবির বলবেন। তাকবিরের সময় হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠানো উত্তম ।
সানা পড়া: প্রথম তাকবিরের পর ইমাম ও মুক্তাদিরা উভয়েই সানা পাঠ করবেন। নিচে সানার আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ দেওয়া হলো:

আরো পড়ুন: দোয়া কুনুত বাংলা উচ্চারণ অর্থসহ
দ্বিতীয় তাকবির: ইমাম যখন দ্বিতীয় তাকবির বলবেন তখন মুক্তাদিরাও একই সঙ্গে তাকবির বলবেন।
দরুদ শরীফ পাঠ: জানাজার নামাজে চারটি তাকবির থাকে, যার মধ্যে দ্বিতীয় তাকবিরের পর দরুদ শরীফ পাঠ করা হয়। এটি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি দুরুদ ও সালাম পাঠানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দ্বিতীয় তাকবিরের পর ইমাম ও মুক্তাদিরা উভয়েই দরুদ শরীফ পাঠ করবেন। নিচে দরুদ শরীফের আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ দেওয়া হলো:

বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ, আমাদের জীবিত ও মৃত, উপস্থিত ও অনুপস্থিত, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ—সকলকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ, আপনি যার জীবন দীর্ঘ করবেন, তাকে ইসলামের ওপর স্থির রাখুন, আর যাকে মৃত্যু দান করবেন, তাকে ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু দিন। হে আল্লাহ! এই দোয়ার সাওয়াব থেকে আমাদের বঞ্চিত করবেন না এবং আমাদের পরবর্তীতে বিভ্রান্ত করবেন না।
আরো পড়ুন: তাহাজ্জুদ নামাজ: নিয়ম নিয়ত ও ফজিলত
চতুর্থ তাকবির: জানাজার নামাজ চারটি তাকবিরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। চতুর্থ ও শেষ তাকবির জানাজার নামাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা শেষ হওয়ার সংকেত বহন করে। এই তাকবিরের পর কিছুক্ষণ নিরব থাকা বা সংক্ষিপ্ত দোয়া করার পর সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করা হয়।
জানাজার নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত
জানাজার নামাজ মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা। জানাজার নামাজের মাধ্যমে মৃত্যুর বাস্তবতা স্মরণ করা হয় এবং দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত থেকে আখিরাতের প্রস্তুতি নেওয়ার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।
জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করলে একজন মুসলমান মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে বাধ্য হয়। এটি তাকে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ীত্ব অনুভব করায় এবং আমল সংশোধন করার প্রেরণা দেয়।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:
“তোমরা বেশি বেশি মৃত্যুর কথা স্মরণ করো, কারণ এটি গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং আখিরাতের জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করে।”
জানাজার নামাজ পড়লে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে বিশাল প্রতিদান প্রদান করেন। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি জানাজার নামাজ পড়বে, সে এক কিরাত পরিমাণ সওয়াব লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি জানাজার সঙ্গে থেকে দাফন পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে, সে দুই কিরাত পরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।”
সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! কিরাত কী?”
তিনি বললেন, “দুটো বিশাল পাহাড়ের সমান।”
জানাজার নামাজ মুসলমানদের পারস্পরিক কর্তব্যের একটি অংশ। এটি ফরজে কিফায়া, অর্থাৎ কিছু লোক আদায় করলে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়, কিন্তু কেউ আদায় না করলে সমগ্র সমাজ গুনাহগার হবে।
যে ব্যক্তি জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করে, সে নিজের জীবন ও আমল সম্পর্কে চিন্তা করে এবং গুনাহ থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য চেষ্টা করে।
জানাজার নামাজ প্রশ্ন ও উত্তর
জানাজার নামাজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, এই ইবাদত সম্পর্কে অনেকের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন থাকে। নিচে জানাজার নামাজের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো।
মহিলারা কি জানাজার নামাজ পড়তে পারবেন
উত্তর: হ্যাঁ, মহিলারা জানাজার নামাজ পড়তে পারেন। ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলাদের জন্য জানাজার নামাজ পড়া বৈধ এবং এতে কোনো বাধা নেই।
তবে, ইসলামী শরিয়তে মহিলাদের জন্য জানাজার নামাজে উপস্থিত হওয়া বা কবরস্থানে যাওয়া সম্পর্কে কিছু মতভেদ আছে। অনেক আলেম মনে করেন, মহিলারা জানাজার নামাজ পড়তে পারেন, তবে কবরস্থানে না যাওয়াই উত্তম।
হাদিসে এসেছে, “নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহিলাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলেন, পরে আবার অনুমতি দিয়েছিলেন।” (তিরমিজি)
অতএব, মহিলারা জানাজার নামাজ আদায় করতে পারেন, তবে সেটি ঘরে বা নির্দিষ্ট স্থানে হওয়া ভালো।
আরো পড়ুন: সহবাসের দোয়া
জানাজার নামাজ ফরজ নাকি ওয়াজিব
উত্তর: জানাজার নামাজ ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ, কিছু লোক আদায় করলে বাকিদের ওপর থেকে দায়িত্ব সরে যায়, তবে কেউ আদায় না করলে সমগ্র সমাজ গুনাহগার হবে।
হাদিসে এসেছে, “যখন কোনো মুসলমান মারা যায়, তখন তার জানাজার নামাজ পড়া এবং দাফন করা মুসলিমদের দায়িত্ব।” (বুখারি, মুসলিম)
এটি মুসলিম সমাজের পারস্পরিক দায়িত্ব, যা মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান ও দোয়া হিসেবে পালন করা হয়।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জানাজার নামাজ কে ইমামতি করেছিলেন
উত্তর: রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জানাজার নামাজ কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি ইমামতি করেননি; বরং সাহাবিরা দলে দলে পৃথকভাবে এসে জানাজার নামাজ আদায় করেন।
হাদিসে এসেছে, প্রথমে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিবার, পরে সাহাবিরা দলে দলে জানাজার নামাজ পড়েন, এবং কোনো নির্দিষ্ট ইমাম ছিলেন না। (ইবনে মাজাহ)
এটি ইসলামের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী একটি ঘটনা, যা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্মান ও মর্যাদাকে বোঝায়।
জুতা পায়ে জানাজার নামাজ পড়া যাবে কি
উত্তর: হ্যাঁ, জুতা পায়ে জানাজার নামাজ পড়া জায়েজ আছে। তবে শর্ত হলো, জুতা ও পায়ের নিচের স্থান অবশ্যই পবিত্র হতে হবে।
হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো কখনো জুতা পরেই নামাজ আদায় করতেন। (আবু দাউদ, তিরমিজি)
তবে, সাধারণত মুসলিম সমাজে খোলা পায়ে জানাজার নামাজ পড়ার প্রচলন বেশি। মসজিদে জানাজার নামাজ পড়লে জুতা খুলে নামাজ পড়াই উত্তম, তবে খোলা মাঠ বা কবরস্থানে পড়লে পবিত্র জুতা পরে পড়তে কোনো বাধা নেই।
স্বপ্নে জানাজার নামাজ পড়তে দেখলে এর অর্থ কী
উত্তর: ইসলামে স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিশ্চিতভাবে করা কঠিন, তবে স্বপ্নে জানাজার নামাজ দেখা বা পড়ার অর্থ বিভিন্ন হতে পারে, যেমন:
কারো জন্য দোয়া ও মাগফিরাতের আহ্বান – স্বপ্ন দেখা ব্যক্তির উচিত মৃতদের জন্য দোয়া করা।
দুঃখ ও শোকের সম্ভাবনা – জীবনে কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা।
জীবনের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি – নতুন পরিবর্তনের ইঙ্গিত, যেমন কাজ পরিবর্তন, স্থানান্তর বা জীবনধারার পরিবর্তন।
আত্মশুদ্ধি ও আত্মবিশ্লেষণের ইঙ্গিত – ব্যক্তি যেন বেশি বেশি তাওবা ও ইবাদত করে।
স্বপ্ন সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো বিধান না থাকায়, আল্লাহর কাছে ভালো অর্থের দোয়া করা এবং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা উত্তম।
আরো পড়ুন: পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ
উপসংহার
জানাজার নামাজ শুধু মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া নয়, বরং জীবিতদের জন্যও একটি শিক্ষা। এটি আমাদের মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই আমাদের উচিত জানাজার নামাজের গুরুত্ব বোঝা।